প্রায় আট হাজার বছর আগে জর্জিয়া, তুরস্ক ও ইরাকের ককেশাস পর্বতের পাদদেশে যে দ্রাক্ষালতা বা আঙুরলতা (ভাইস ভিনিফেরা) আবিষ্কৃত হয়েছিল তা-ই হলো আজকের জগদ্বিখ্যাত পানীয় ওয়াইনের আদিবংশ।
ওয়াইন-হুইস্কি-ভোদকা-রাম মায় সবধরনের সুরারসের সাধারণ বাংলা রূপ মদ। কিন্তু ওয়াইনে মদিরতা থাকলেও কোনওভাবেই একে মদের পর্যায়ে ফেলাটা ঠিক না। মদ বললে ওয়াইনের ঐতিহ্য-কৌলিন্য ও আভিজাত্য ক্ষুণ্ণ হয়। ওয়াইন মূলত একটি অপ্রমত্ত, পরিমিত বোধের পানীয়। ওয়াইনে অ্যালকোহলের মাত্রা খুব বেশি থাকে না। শতকরা পাঁচ থেকে তেইশ ভাগের মতো অ্যালকোহল থাকার মাত্রা নির্ধারিত থাকলেও সাধারণত বেশির ভাগ ওয়াইনে থাকে বারো থেকে চৌদ্দ ভাগ। আমাদের বাংলা অঞ্চলে অন্যসব অ্যালকোহলিক পানীয়ের মতোই ওয়াইনকে সোমরস বা দ্রাক্ষারস নামে অবহিত করা হয়।
ওল্ড টেস্টামেন্টের বর্ণনা অনুযায়ী পৃথিবী ডুবানো ভয়াবহ বন্যা শেষে নুহ্ নবি নৌকা থেকে নেমে সবচেয়ে প্রথম যে কাজগুলো করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল দ্রাক্ষালতা বা আঙুরগাছ রোপন করা। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে লেবানন অঞ্চলে ওয়াইন তৈরির হদিস পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে এই বিদ্যা ছড়িয়ে পড়ে গ্রিসে এবং গ্রিকদের কাছে ওয়াইন পরম পানীয়ের সমাদর লাভ করে। এরপর ক্রমে ক্রমে গ্রিসেও ওয়াইন উৎপাদন বিকাশ লাভ করে।
প্রাচীন রোম সাম্রাজ্য যেসব অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেছিল, সেসব অঞ্চলে আঙুরলতার ফলনও ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর আঙুরলতা মানেই তো ওয়াইন। সেই সময়ে গির্জা আর মঠগুলোতে ওয়াইন উৎপাদন এবং পরিবেশনের গৌরবময় ঐতিহ্য লক্ষ্য করা যায়। গির্জার অধীনে আঙুর চাষ ও ওয়াইন তৈরির জন্য তখন অনেক জমি বরাদ্দ দেয়া থাকতো এবং প্রচুর জনশক্তি যুক্ত থাকতো। ওয়াইন উৎপাদন ছিল গির্জা ও মঠগুলোর অর্থ উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এভাবে পশ্চিমে খ্রিস্টধর্মের সংস্কৃতি বিকাশে ওয়াইনও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল। খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস করা হয় ওয়াইন ইজ মেইড বাই গড। যিশুকে নিয়ে আঁকা বিভিন্ন চিত্র-শিল্পেও ওয়াইনের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিশ্ব-বিখ্যাত চিত্রকর্ম দ্য লাস্ট সাপারেরও অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ওয়াইন।
অপরদিকে পূর্বে ইসলামের আবির্ভাবের কারণে ওয়াইন সংস্কৃতির বিকাশ বিঘ্নিত হয়। দেখা যায় যেসব দেশ থেকে ওয়াইনের উৎপত্তি ঘটেছিল; ইসলাম ধর্মের প্রসারের কারণে সেসব দেশে ওয়াইনের প্রকাশ্য উৎপাদন ও পান চর্চা পর্দার আড়ালে চলে গেছে, কিছু ক্ষেত্রে বিলুপ্তিও ঘটেছে।
খ্রিস্টান মিশনারীরা একসময় মেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া, আর্জেন্টিনাতে আঙুর চাষের বিস্তার ঘটিয়েছিল। পরবর্তীকালে অভিবাসীদের হাত ধরে ইউরোপে আঙুর চাষ ছড়িয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজল্যান্ডে ইংরেজ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাচদের মাধ্যমেই আঙুরচাষ এবং ওয়াইনের প্রসার ঘটেছিল।
বেদ-মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায় সোমরসের কথা উল্লেখ থাকলেও তা আঙুর থেকে তৈরি কি না তার উল্লেখ নাই। তবে কোথাও কোথাও উল্লেখ আছে, সুরা হলো সোমলতা থেকে তৈরি মদ। আবার হিন্দু ধর্মে মদ বা নেশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এভাবে, ‘সুরা বৈ মলমন্নানাং পাপ্মা চ মলমুচাতে’ মানে হলো সুরা অন্নের মল স্বরূপ। তবে দেবতা ইন্দ্রের সোমরস পানের ইচ্ছা হলে তিনি যজ্ঞত্রয়ে সোমরস পান করেছিলেন। আবার সোমরস আর্য এবং প্রাকবৈদিক যুগের ঋষিদের অতি প্রিয় পানীয় ছিল। পুরাণ মহাভারতে বারবার সোমরসের উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্জুন, কৃষ্ণ, সুভদ্রা ও দ্রৌপদীদের যমুনার তিরে বনভোজনে পান করার মতো গল্প প্রচলিত আছে। যজ্ঞ হোক বা বিনোদনের জন্য হোক নারীরাও সমান ভাবে এই করণ-সুধার ভাগিদার ছিলেন, বাৎসায়নের কামসূত্রে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
পৃথিবীতে পাঁচশতেরও বেশি জাতের আঙুর গাছ আছে, এর মধ্য থেকে মাত্র একশত রকম জাতের আঙুর দিয়ে ওয়াইন তৈরি করা হয়। উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূল অঞ্চলে বিশেষ এক ধরনের আঙুর গাছ জন্মে যা অন্য কোনও অঞ্চলে তেমন দেখা যায় না। এই আঙুরের স্বাদ ও গন্ধ আলাদা রকমের। কথিত আছে, এই আঙুরের গন্ধের সাথে শেয়ালের খামারের গন্ধের সাদৃশ্য আছে। ওয়াইন তৈরিতে ব্যবহৃত বেশিরভাগ আঙুর গাছ উত্তর আমেরিকার এই শেয়ালগন্ধা আঙুর গাছের শেকড়ের গ্রাফ বা কলম। একটি আঙুর গাছে ফলন আসতে সাধারণত সময় লাগে তিন বছর। ওয়াইনের জন্য সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়সি কাণ্ড বা শেকড়সম্পন্ন গাছের আঙুর প্রধান্য দেয়া হয়। তবে কমপক্ষে ৫০ বছরের কম বয়সি কাণ্ড বা শেকড়সম্পন্ন গাছের আঙুর ওয়াইন তৈরির জন্য বিবেচনাতেই আনা হয় না।
বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র A Walk in The Clouds বা Four Steps in The Clouds উপন্যাসের মূল গল্প ছিল, একটি আঙুর বাগান পুড়ে গেলে একটি পরিবার তাদের বংশ পরম্পরার ওয়াইন তৈরির ব্যাবসা হারাতে বসে। পরিবারটিতে নেমে আছে অস্তিত্ব হারানোর হাহাকার। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া বাগানের মধ্যে একটি জীবিত আঙুর গাছের কাণ্ড উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সেই কাণ্ডটিই তখন পুরো পরিবারের আনন্দ, আশা ও বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে ওঠে।
আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হলো, একই আঙুর গাছের কাণ্ড থেকে ভিন্ন ভিন্ন জমিতে উৎপন্ন আঙুর থেকে তৈরি করা ওয়াইনের স্বাদও হয়ে থাকে ভিন্ন ভিন্ন রকমের। আঙুর গাছ লতা জাতীয় গাছ। প্রতিবছর এই লতাগুলো শুকিয়ে যায়, আবার বসন্তে জেগে উঠে। বসন্তকালেই আঙুর গাছ ছাটাইয়ের কাজও করা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, ছাটাইয়ের সময় ও নৈপুণ্যের উপরও ওয়াইনের গুণগত মান এবং স্বাদ নির্ভর করে। আঙুরলতা গাছ কখনও মাটি বরাবর এগোয়, কখনও গুল্মের মতো, আবার কখনও বা লম্বা লগের মতো বেড়ে উঠে ছাদের আকার ধারণ করে। আঙুর চাষের জন্য জমির মাটি হতে হয় বালি, নুড়ি আর পাথরের সংমিশ্রণ। সূর্যের আলো ও তাপ আঙুরের ফলনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
উত্তর মেরুর কাছাকাছি নরওয়ে শীত প্রধান দেশ। নরওয়ের গ্রীষ্মকাল বাংলাদেশের শীতকালীন আবহাওয়ার প্রায় কাছাকাছি। এতসবের পরেও নরওয়ের ভেস্টফোল্ড প্রভিন্সে কিছু আঙুর চাষ হয়। কাকতালীয়ভাবে আমি এই অঞ্চলে বসবাস করলেও এখনও কোনও আঙুর বাগান দেখার সুযোগ হয়নি। শুনেছি, এই অঞ্চলের আঙুর দিয়ে বানানো ওয়াইনের স্বাদ আলাদা ধরনের হয়ে থাকে।
ইতালিতে দীর্ঘ, সরু, ছোট, খাড়া ধরনের অনেক পাহাড় আছে। আছে ঢালু উপকূল যা আল্পসের পাদদেশে অবস্থিত। সেখানকার আবহাওয়া সাধারণত শীতল। আবার দক্ষিণাঞ্চল ভূমধ্যসাগরের দিকে বলে বেশ উষ্ণ। এইসব ভৌগলিক কারণে ইতালিতে ভাল মানের আঙুর জন্মে এবং ভাল ওয়াইন তৈরি হয়।
উত্তর গোলার্ধে সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যে আঙুর তোলা হয় এবং এর ছয়মাস আগে তোলা হয় দক্ষিণ গোলার্ধে। উত্তাপের কারণে দক্ষিণের আঙুরে চিনি বেশি থাকে।
আঙুরের পরিপক্কতা, মিষ্টি, এ্যসিডের যথাযথ সমন্বয় এবং আঙুরের খামির সাথে জল ও চিনির মাত্রামতো মিশ্রণ; ভাল মানের ওয়াইন তৈরির প্রধান শর্ত। ওয়াইন তৈরিতে কোয়ানটিটি নয় ফোকাস করতে হয়, নিশ্চিত করতে হয় কোয়ালিটি।
এক লিটার পাকা আঙুরে দুইশত গ্রাম চিনি থাকে, আর এক শতাংশ অ্যালকোহল পেতে সতেরো গ্রাম চিনির প্রয়োজন হয়। বাগান থেকে আঙুর তোলার পর এগুলো মেশিনে দিয়ে দেয়া হয়, যা ডালপালা থেকে আঙুরকে পৃথক করে। তারপর তা খামিরে রূপান্তরিত করা হয় এবং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গাঁজন বা ফারমেন্টেসনের জন্য কাঠ, সিমেন্ট বা স্টিলের ড্রামে রাখা হয়। এই ড্রামের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়। আগে খামির তৈরির কাজটি পা দিয়ে মাড়িয়ে করা হতো, এবং সেটি নি:সন্দেহে ছিল একটি রোমান্টিক উৎসব।
একসময় ওয়াইন কাঠের ব্যারেলে সংরক্ষণ করা হলেও এখন স্টিলের ড্রামে সংরক্ষণ করা হয়। ব্যারেলে ওয়াইন ছয় মাস থেকে বিশ বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকতে পারে।
রেড ওয়াইনে অ্যালকোহলের পরিমাণ হোয়াইট ওয়াইন থেকে বেশি থাকে। রেড ওয়াইন নীল বা লাল আঙুর থেকে তৈরি করা হয়। পিংক ওয়াইন তৈরি হয় নীল আঙুর থেকে। এই ওয়াইন তৈরিতে রেড ওয়াইনের চেয়ে কম সময় লাগে। সাধারণত সবুজ এবং ক্ষেত্র বিশেষে নীল আঙুর দিয়ে তৈরি হয় হোয়াইট ওয়াইন। ওয়াইনে ব্যবহৃত শব্দ DRY মানে হলো মিস্টির বিপরীত।
ফ্রান্সের শ্যাম্পেন শহরে উৎপাদিত ঝলমলে বা স্পার্কলিং ওয়াইনের নামই হলো শ্যাম্পেন। শ্যাম্পেনের জন্য সাধারণত তিন রকম আঙুর ব্যবহার করা হয়, দুইটি নীল এবং একটি সবুজ আঙুর। অনেক ধরনের শ্যাম্পেন হয়ে থাকে। শ্যাম্পেন তৈরি বেশ ব্যয় বহুল।
বিভিন্ন রকম ফল দিয়েও ওয়াইন বানানো হয়। এগুলো ফ্রুট ওয়াইন নামে পরিচিত।
একটি প্রবাদ আছে A meal without wine called breakfast । এই মন্ত্রে দিক্ষিত হয়ে ওযাইন পান করতে চাইলে ওয়াইনের বিষয়-আশয় সম্পর্কে জানাটাও জরুরি। জানা মানে ওয়াইন নির্বাচন। অর্থাৎ কোন সময়ে কোন ধরনের খাবারের সাথে কোন ওয়াইন পান করতে হয়। যে কোনও সময় যে কোনও ধরনের খাবারের সাথে যে কোনও ওয়াইন, ড্রিংকিং এথিকস বা রসুমের সাথে যায় না। ওয়াইন নির্বাচনের জন্য একটা প্রচলিত নিয়ম হলো এরকম, হালকা গরম চিকেন বা সাদা মাংসের সাথে রেড ওয়াইন এবং ঠাণ্ডা চিকেনের সাথে হোয়াইট বা পিংক ওয়াইন। লাল মাংস এবং কড়া স্টেকের সাথে রেড ওয়াইনই আরাধ্য। মাংস হালকা ভাজা হলে যে কোনও ওয়াইন চলে। মশলাদার খাবারের সংগে আধা শুকনা হোয়াইট ওয়াইন বা জুসি রেড ওয়াইনের সমন্বয় হয়। সাদা রঙের মাছের সাথে সাধারণ হোয়াইট ওয়াইন এবং গোলাপি বা লাল রঙের মাছের সাথে ড্রাই হোয়াইট ওয়াইন নেয়াটা নিয়ম। আবার চিজ জাতীয় খাবারের সাথে রেড বা হোয়াইট বা ডেজার্ট ওয়াইন, যে কোনটাই পান করা যায়। স্টাটার্ট হিসাবে শ্যাম্পেন এবং ডেজার্ট হিসাবে যে কোনও কড়া ওয়াইন পরিবেশন করা হয়।
এক বোতল ওয়াইন, এবং কিছু স্ন্যাকস নিয়ে বন্ধু বা বন্ধুদের সাথে আড্ডা মানেই Wine flies when you are having fun…